জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী
- আপডেট সময় : ১০:৫২:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪ ৮ বার পড়া হয়েছে
সাঈদ আবদুল্লাহ : একেবারে জীবন সায়াহ্নে উপনীত হওয়া ৯৬ বছরের একজন বৃদ্ধ, কিন্তু তিনি-ই রাজপথে জনতার স্রোতকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ফারাক্কা লংমার্চে—ভাবা যায় এই ব্যাপারটা! বলছিলাম আমাদের ভাসানী সাহেবের কথা!
রাজনীতির সবচেয়ে বড় গুণ যদি হয় সর্বসাধারণের সাথে মিশে যেতে পারার ক্ষমতা, তাহলে এই ক্ষেত্রে আবদুল হামিদ খানের চেয়ে কীর্তিমান খুব কম মানুষই ছিলেন। কথা-বার্তা, চাল-চলনে এতটা সাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দিক থেকে অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের এমন সংমিশ্রণ প্রায় দুর্লভই বলা চলে।
১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সিরাজগঞ্জে, যদিও পরবর্তী জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটান টাঙ্গাইলে। একেবারে অল্প বয়সে বাবাকে হারান। চার ভাইবোনের ভেতরে তিনি ছিলেন সবার ছোট, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বড় তিন ভাই বোনই একেবারে অল্পবয়সে মারা যান। বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যাশিক্ষা করেছেন সাধ্যমতো।
ভাসানচরের কৃষকেরা ভালবেসে তার নাম দিয়ে দিয়েছিল ভাসানী। খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন,ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ এমনকি যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।
রাজনীতি করেছেন সবসময় মানুষকেন্দ্রিক, দলের চেয়ে মানুষের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখতেন সবসময়। যখন দেখেছেন কংগ্রেস মুসলমানের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট নয়, দল পরিবর্তন করে যোগ দিয়েছেন মুসলিম লিগে। মুসলিম লিগের নানারকম স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতির সাথে অনেক ক্ষেত্রেই একমত হতে পারেন নি, সরাসরি মুখ ফুঁটে কথা বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে, এইজন্য রোষানলেও পড়তে হয়েছে।
যখন দেখলেন মুসলিম লিগ আর সাধারণ মানুষের দল নেই, তখন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন আওয়ামের (সাধারণ মানুষের) জন্য আওয়ামী মুসলিম লিগ। যেটা আজকের বাংলাদেশের আওয়ামী লিগ। ভাসানী সাহেব ছিলেন আওয়ামী লিগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি। পরবর্তীতে কিছু বিষয় মতানৈক্যের সৃষ্টি হলে আওয়ামী লিগ থেকে বের হয়ে গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(ন্যাপ)। ভাসানী বাম ঘরানার রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করতেন, আবার অনেক টিপিক্যাল বাম ঘরানার লোকদের মত ধর্মকে অবজ্ঞা করে চলে যারা, ভাসানী ছিলেন তাদের একবারে বিপরীত মেরুতে।
ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন তিনি। তবে তিনি ছিলেন সবার প্রতিই, সব মতবাদের প্রতিই উদারমনা। ১৯৫৬ সালে সংবিধানিকভাবে পাকিস্তানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তিনি আন্দোলন করেন, তিনি চেয়েছিলেন একটি উদারকেন্দ্রিক নিরপেক্ষ সমাজ। এমনকি পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথের গানকে নিষিদ্ধ করলে তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেন ভাসানী।
ভাসানী অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের বলি। ১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম (বিদায়)’ বলে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাসানী সাহেবের বয়স ছিল ৯১ বছর। ভারতে অবস্থানকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় রূপ দেওয়ার জন্য ৮ সদস্য বিশিষ্ট যে কমিটি করা হয়েছিল, ভাসানী সাহেব ছিলেন তার সভাপতি।
মুক্তিযুদ্ধের পরেও থেমে থাকেনি ভাসানীর বজ্রকণ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও দেশে শেখ মুজিবের শাসনামলে নানারকম অনাচার ঘটতে থাকে, ভাসানী সেগুলোর বিরুদ্ধে অনশন করেন কয়েকবার। বেশ কিছু ইস্যুতে শেখ মুজিবের সাথে তার সরাসরি দ্বিমত ছিলো, ভারতের সাথে মৈত্রী চুক্তিতেও বিরোধ ছিল তার।
বিভিন্ন সময়ে জীবনের অনেকগুলো দিন কেটেছে তার কারাগারের অন্ধ গহ্বরে। ভাসানীর জেল-জীবন নিয়ে বিস্তর গবেষণার স্কোপ আছে বলেই মনে করি।
ভারত কর্তৃক অবৈধ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস আগে ফারাক্কা অভিমুখে বিশাল লংমার্চে নেতৃত্ব দেন তিনি। ৯৬ বছর বয়সী একজন মানুষের দৃঢ় পদচিহ্ন এখনও স্মৃতিতে চিরভাস্মর হয়ে রয়েছে আপামর জনতার হৃদয়ে।
চিরকাল গরিব, দুঃখী, মেহনতী মানুষের অধিকার নিয়ে লড়ে গেছেন। রাজনৈতিক স্বার্থ, দলীয় কাঠামো কিংবা ক্ষমতার লোভ—কোনকিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি তার সংগ্রামী পথে। জনতার সাথে তিনি চিরকাল মিশে গেছেন জনতার কাতারে থেকেই। তাইতো সাধারণ জনতা তাকে এখনও স্মরণে রেখেছে মজলুম জননেতা হিসাবে।
লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি— সহজ ভাষায় বলতে গেলে এইতো তার বেশভূষা। তাই বলে সহজাত বিচার বুদ্ধিতে তাকে ‘আনস্মার্ট’ ভেবে বসবেন না যেন। সুইডেন, রাশিয়া, চীন সফরে গিয়ে সেখানে বলিষ্ঠ পদচারণা করে এসেছেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বাইরের দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায়ের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখেন তিনি।
ভাসানীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল খুবই অসাধারণ। পাকিস্তান থেকে দেশটা স্বাধীন হলেও, এই বাংলাদেশ যাতে কোনমতেই ভারতের হুকুমতের রাষ্ট্রে পরিণত না হয়, সেই ব্যাপারেও ভাসানী ছিলেন একেবারে নির্ভীক এক সংগ্রামী নেতা। সত্যিকার অর্থেই তিনি দেশটাকে সবধরনের সকল বহিঃপ্রভাব থেকে মুক্ত একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন চিরকাল।
১৯৭৬ সালের এইদিনে (১৭ নভেম্বর) পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের মত পাড়ি জমান অসীমের পথে। আজ তার প্রয়াণদিবস। একটা বিষয় খেয়াল করে দেখেছেন, কত সহজেই তার মত একজন মহান ব্যক্তিকে ভুলে গেছে অনেকে। অবশ্য ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক! কারণ টেকনিক্যালি এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে ভুলিয়ে রাখা হয়েছিলো তার ব্যাপারে।
ইতিহাস মানে তো শুধু এক পরিবারের চর্বিত চর্বন জিনিসপত্র আর ওভারগ্লোরিফিকেশন দিয়ে বোঝাই করা গালগপ্প গেলানো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এমনকি আওয়ামী লিগের প্রতিষ্ঠাদিবসেও তারা ভাসানীর নাম স্মরণ করতো না, ভাসানীর মৃত্যুদিবসও নিয়ে দেশে কোন স্মরণসভাও হতো না তাদের পক্ষ থেকে।
সে যাই হোক, এইদেশ নানা কারণেই ভাসানীর কাছে ঋণী। ভাসানী সাহেবকে তরুণরা যাতে জানতে ও অনুধাবন করতে পারে, সেই প্রচেষ্টা জারি রাখাটা কর্তব্য। তার মৃত্যুদিবসে প্রার্থনা জানাই, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসীব করেন। আর আমাদের দেশের সবার মনে ভাসানীর স্মৃতি চিরভাস্মর হয়ে থাকুক, তরুণ প্রজন্মও তাকে চিনতে থাকুক, গবেষণা হতে থাকুক ভাসানী নিয়ে—সেটাই থাকবে কামনা।