জনপ্রশাসনকে সুন্দর কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো সকলের দায়িত্ব : সংস্কার কমিশন
- আপডেট সময় : ০১:১৫:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১ বার পড়া হয়েছে
জনগণের কীভাবে উন্নয়ন হবে, সে জন্য কাজ করবে জনপ্রশাসন। তাই জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে জনপ্রশাসনকে সুন্দর কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো সকলের দায়িত্ব বলে মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এ কথা বলেন। সরকারের উদ্দেশ্য জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা। সরকারি কর্মচারীদের কাজ স্বচ্ছ রাখতে নাগরিকরা যে সেবা চাচ্ছেন বা সেবা পেতে কোথায় সমস্যা দেখছেন এবং কীভাবে এর সমাধান সম্ভব, সেসব বিষয়ে নাগরিকদের মতামত জানতে চান তারা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সভাপতিত্বে সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া, ড. মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা, মিহরাজ আহমেদ ও মেহেদী হাসান। সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া বলেন, ‘দুর্নীতি ও রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদ ও জনপ্রশাসনের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে। কখনও কখনও দেয়ালটা ভেঙে একত্রিত হয়ে যায়। এটা সমাজকে ক্ষতি করে। সে জন্য অনেকেই বলেছেন, এক্ষেত্রে একটি চেক এন্ড ব্যালেন্স দরকার। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে এক ধরনের কাজ আছে, যা রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষতি করে।
সরাসরি রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়- যেটা ব্যক্তি, দল, সরকার ও সবার ঊর্ধ্বে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব জনপ্রশাসনের। যে সমস্ত কাজে নাগরিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা আছে, সেক্ষেত্রে আইন-কানুন বাস্তবায়নে জনপ্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। একইভাবে সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নাগরিকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, অতীতে যেভাবে ফ্যাসিবাদী সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে ফেলেছে, সেখান থেকে ফিরে আসতে প্রশাসনের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রশাসনের থেকে নাগরিকদের ভূমিকা বেশি রাখতে হবে। সেজন্য সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করার কোন বিকল্প নেই।
নাগরিকদের শক্তিই রাষ্ট্র কাঠামো সৃষ্টিতে বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।প্রশাসনকে জনমুখী, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা উল্লেখ করে ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া বলেন, জনপ্রশাসনকে বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রশাসনে একটি সুন্দর কাঠামো তৈরি করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দেশের নাগরিকদের যে প্রত্যাশা, তা পূরণ করার জন্য আমরা সবাই মিলে সংস্কার কাজে হাত দিয়েছি। মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান বলেন, জনপ্রশাসনে সংস্কার করতে হলে প্রথমে প্রশাসনে যারা ভাল কাজ করবে, তাদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তারা জনগণকে সেবার মান নিশ্চিতে কাজ করে।
তাদের দেখে প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারাও ভালো কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়। তিনি বলেন, একটি অ্যাপস এর মাধ্যমে নাম-পরিচয় গোপন রেখে কর্মকর্তাদের কাজের রেটিং পয়েন্ট আকারে রেখে দেওয়া, যেন পরবর্তীতে তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন করা হয়। এতে করে প্রশাসনের কর্মকর্তারা জনগণকে সেবা দিতে গড়িমসি করবে না। অধ্যাপক নোমান আরও বলেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের মান ও সততার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মো. কামাল উদ্দিন বলেন, আমাদের মাইন্ড সেটআপ পরিবর্তন করতে হবে, পুলিশ প্রশাসনকে কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে জনগণেরও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
একটি দেশের রাষ্ট্রকাঠামো যেভাবে গড়ে ওঠে, ঠিক দেশের জনগণ ও প্রশাসনও সেভাবে গড়ে ওঠবে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের দুর্নীতির যে নেটওয়ার্ক আছে, তা ভেঙে দিতে না পারলে স্বচ্ছ ও জনবান্ধব প্রশাসন পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের দেশে অন্যায় করে পাড় পেয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি রয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক মুস্তফা নঈম বলেন, বর্তমান সময়ে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল কলেজের কোচিংয়ের চাপে গ্রামীণ সংস্কৃতি ও সামাজিকতা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। এসব থেকে আমাদের বের হতে হবে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক সম্প্রতি ভূমি অফিসের তহসিলদারদের পোস্টিং দিয়েছেন লটারির মাধ্যমে।
এতে একটা বিষয় পরিলক্ষিত হয় যে, প্রশাসনে থেকেও সততার সাথে কাজ করা যায়। কোন তদবির বা ঘুষ ছাড়াও সঠিক পদায়ন হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মেহেদী হাসান বলেন, ‘যাদের পকেটে টাকা আছে, তারাই ঘুষ দেয়। সমাজের তথাকথিত এলিট শ্রেণি এই ঘুষ প্রথা চালু করে। রাজনীতিবিদ তার কমিটমেন্টের বাইরে কাজ করলে, তাকে প্রতিহত করব। কেউ ঘুষ চাইলে, তাকে প্রতিহত করব।তিনি আরও বলেন, যারা আইন তৈরি করে, তারাই আইন ভাঙে। তাই এই শর্ষের মধ্যে থাকা ভূত তাড়াতে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।
রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, প্রশাসনের কাজে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ম বর্হিভূত কোন হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া যাবে না। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। রাষ্ট্রে যে লাল ফিতার দৌড়াত্ব রয়েছে, সেটি বন্ধে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সভায় আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সদস্য সচিব সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচি ও মানবাধিকার সংগঠক জেসমিন সুলতানা পারুসহ অসংখ্য গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সাংবাদিকরা।